Responsive Ads for Rent

Saturday 12 October 2019

ভিন্নমত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

 
 মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
ডিসেম্বর-মার্চ এলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গদ গদ করি। যদিও প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী সেই বিষয়টি মনে-প্রাণে ধারণ করাতো দূরের কথা, একটু বুঝতেও চেষ্টা করি না। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভেতরে ধারণ করতে চাইলে ধান্দাবাজি করা যাবে না সেই বিষয়টি অবশ্য জানি! তাই যে যা বলুক ভাই বাইরেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারণকারী হতে চাই!’– এমন চেতনাধারীতে এখন দেশ ভরে গেছে। আর এই কথিত চেতনাধারীরাই তাদের স্বার্থবিরোধী সত্য কথা বললেই যাকে-তাকে রাজাকার, জামায়াত, শিবির অভিধায় অভিহিত করে হয়রানি করছে। বুয়েটের ছাত্র আবরারের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলছে। যদিও সব শুদ্ধ মতের মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শর্ত।
A
পাকিস্তানিদের মতো সত্য কথা প্রকাশকারীদের দেশবিরোধী-ইসলামবিরোধী অভিহিত করাটা আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মনে হয়, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দূরে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরে যাচ্ছি। তাই ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে পাকিস্তানিদের কৌশল অবলম্বন করে যাকে-তাকে স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, জামায়াত, শিবির অথবা ইসলাম ধর্মবিরোধী, নাস্তিক ইত্যাদি বলছি।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের সমালোচনাকারীদের ‘ভারতের চর’ অথবা ‘নাস্তিক’ উপাধি দিয়ে দেশ ছাড়ার সব বন্দোবস্ত করে। যারা জন্মভূমির মায়ায় এদেশ ছেড়ে যেতে চায়নি, তাদের ওপর নেমে এসেছিল জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন। জেলের অন্ধকার কারাগার হয়েছিল তাদের ঠিকানা। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখের বালি। বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়াকে সমর্থন করলেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ইয়াহিয়া গংদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবীদের হতে হয়েছিল ধর্মদ্রোহী অথবা ভারতের দালাল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগী আল-বদর, আল-শামস, রাজাকাররা বাঙালি নিধনকে বৈধতা দিতেও এ তত্ত্ব ব্যবহার করে। তারা প্রচার করে, ‘ইসলাম ধর্মকে রক্ষা ও ভারতের দালালকে প্রতিহত করতেই তাদের এই অভিযান।’ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংগ্রাম পত্রিকার পাতায় পাতায় তৎকালীন বদর বাহিনী নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট।
ভিন্নমতাবলম্বীদের মতকে যুক্তি নয়, অস্ত্রের মাধ্যমে মোকাবিলা করার পাকিস্তানি মানসিকতা স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখা যায়। সামরিক শাসনামলে ভিন্নমত বা পথের মানুষ হওয়ার কারণে গোপনে বহু সামরিক- বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা না হলেও নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। হামলা-মামলার বহু ঘটনা ঘটেছে। সত্য বলায় বারবার বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো মহীয়সী নারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে অবস্থার খুব পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। কেউ আওয়ামী লীগ ও সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইত্যাদি বলে দমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু মতের পার্থক্য থাকায় অনেককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে শহীদ মিনারে। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিন্নমত সহজে গ্রহণ না করার ফলই আজকের শহীদ মিনার, স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ আমরা সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই ভিন্নমতকে যুক্তির মাধ্যমে নয়, শক্তির মাধ্যমে প্রতিহতের চেষ্টা করছি। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমরা চিন্তাচেতনায় কি সেই পাকিস্তানের দিকেই ফেরত যাচ্ছি?
আমরা ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সব মতের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে একমত নাও হতে পারি। তবে এই মতভিন্নতার কারণে যারা তাদের শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করছে অথবা রাজাকার, জামায়াত, শিবির বলে পিটিয়ে হত্যা করছে, হামলা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে, তাদেরও সমর্থক নই। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাষায় বলতে চাই: ‘আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাতে অবাধে বলতে পার, তার জন্য আমি নিজের প্রাণ অবধি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।’ এটা শুধু ভলতেয়ারের কথা নয়; আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাও বটে।
সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কথা বললেই সেটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়ে যায় না। রাষ্ট্র ও সরকার আলাদা দুটি সত্তা। ১৯৪৭ থেকে ৭১ (যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে বাদে) দেশপ্রেমিক রাজনীতিকরা পাকিস্তানি শাসনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শিক্ষক, সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীরা সত্য কথা বলেছিলেন। আর এই রুখে দাঁড়ানোর কারণ ছিল গণতন্ত্রহীনতা। আজ দেশ যদি সেই গণতন্ত্রহীনতার পথে হাঁটে, আর কেউ গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেন, তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু নয়, বরং প্রকৃত বন্ধু।
আজ যারা দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে কথা বলছেন তাদের রাজাকার বলে গালি দেওয়া, শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করা; আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করে তাহলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র আর সরকারের সমালোচনা করা এক বিষয় নয়। সরকারের সমালোচনা করলেই এখন তাকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভিন্নমত দমনের এই প্রতিক্রিয়া থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিশেষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসীদের উচিত হবে কাউকে রাজাকার, জামায়াত, শিবির, দেশবিরোধী বলার আগে তার অবস্থানকে বা বক্তব্যকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃষ্টিাকোণ থেকে বিচার করা। কেউ সত্য বললে তা মেনে নেওয়া। বিশ্বকবির ভাষায়: ভালো মন্দ যাহাই আসকু/সত্যেরে লও সহজে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment