Responsive Ads for Rent

Saturday 12 October 2019

ছাত্ররাজনীতি কতটা বাঞ্ছনীয়?


 সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাঃঃ
সহিংসতার জন্য যুক্তি লাগে না, লাগে কেবল একটি উপলক্ষ। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের ফেসবুক পোস্ট ছিল একটি উপলক্ষ মাত্র, আগের বহু ঘটনার মতোই এই ঘটনায়ও আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের ছাত্ররাজনীতি কেবল নিষ্ঠুরতা আর হিংসার পাঠ দেয়, সেটা যে বিদ্যাপীঠই হোক না কেন। এবং আমাদের রাজনীতি এই শিক্ষাও দেয়, যেকোনোভাবেই হোক একটি পর্যায়ে গিয়ে খুনিদের পেছনে একটি গোষ্ঠীর সমর্থন থাকছে এবং থাকবে।
A
‘বেরিয়ে আসছে নির্যাতনের রোমহর্ষক সব ঘটনা’—এই শিরোনামে মঙ্গলবার প্রথম পাতায় দৈনিক সমকাল একটি প্রতিবেদন করেছে। রিপোর্টার লিখেছে, বুয়েটের হলে হলে এক শ্রেণির ছাত্রলীগ নেতার নির্যাতন সেল আছে এবং সেগুলোয় এ পর্যন্ত ঘটেছে শত শত নির্যাতনের ঘটনা। আবরার হত্যার পর ঘটনা সামনে এলো কেবল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব জেনেও নীরবে মেনে নিয়েছে, যেমন করে উপাচার্য তার ছাত্রের জানাজায় না এসে নীরব থেকেছেন নিজ বাড়িতে।
A
কিছু কিছু ঘটনায় হৃদয় যেভাবে সাড়া দেয়, মস্তিষ্ক তাতে ষোলো আনা সায় দিতে পারে না, প্রশ্ন তোলে। জানি এবং মানি, ছাত্ররাজনীতি যারা করে সবাই সমান নয়। কিন্তু একথা কি সবাই মানি, বিদ্বেষের রাজনীতি প্রচারের যে তুমুল ও বহুমুখী প্রচেষ্টা চলছে, তার প্রধান লক্ষ্য দেশের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। নানাভাবে, নানা দিক থেকে এই রাজনীতি তাদের দখল নিতে চায়। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও সেই সর্বগ্রাসী তৎপরতার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি বলে আমরা জানতাম, তার অন্যতম বুয়েট। কিন্তু আমরা ভুল জানতাম।
রাজনীতি যে ক্রমেই বিপরীত মতকে গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে, তা আরও একবার প্রমাণিত হলো। আবরারের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য পাল্টা যুক্তি না দেখিয়ে তাকে টানা সাত ঘণ্টা নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এবং এরা কতটা নির্দয় আর নিষ্ঠুর হলে, খুন করে এসে আরাম করে, ঠান্ডা মাথায় টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতে পারে!
আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে, যারা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি করেন, শিক্ষক বা ছাত্র, অন্যদের তুলনায় তাদের রাজনীতিতে চিন্তার প্রসারতা তুলনামূলক বেশি থাকবে, কারণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মনকে প্রসারিত করা। এমন একটি প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকে দেখলে আমাদের আর কোনও আশার জায়গা থাকে না। কারও মতামত পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু তাকে বলবার সুযোগই দেওয়া যাবে না, এই উগ্রতা সমাজের অগ্রতার প্রশ্নে প্রাণঘাতী।
ছাত্ররাজনীতি কতটা হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে, তার বিপজ্জনক উদাহরণ আবরারের খুন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের ছাত্ররাজনীতিতে সহিংসতার আধিক্য বহু দিনের। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশের নানা প্রান্তে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে যে আতঙ্কের পরিবেশ আমরা দেখছি, তা অভূতপূর্ব। আমরা এতটাই বিভাজিত হয়েছি, পরিস্থিতি যতই অগ্নিগর্ভ হোক, কিছু মানুষের নিকট রাজনৈতিক আনুগত্য বজায় রাখাই অধিকতর জরুরি। তারা বলে চলেছে, যেহেতু পুলিশ খুনিদের আটক করেছে, তাই আন্দোলনের প্রয়োজন নেই, খুনের প্রতিবাদ করার প্রয়োজন নেই।
আজ যা ছাত্রলীগ করছে, আগে তা করেছে ছাত্রদল, শিবির—কম বা বেশি। আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বহু দিন যাবৎ সহিংসতানির্ভর। ইসলামী ছাত্রশিবিরের রগ কাটা থেকে আজকের এই পিটিয়ে হত্যা। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এবার হিংস্রতার মাত্রা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু তা মাত্রার ফারাক মাত্র, চরিত্রের নয়। এবার নতুন কী হলো? আসলে যা নতুন, তা-ই সর্বাধিক উদ্বেগের। এত দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারে লড়াই হতো, মারামারি হতো, এখন এক অতি অপরিচিত অরাজনৈতিক ছাত্র নৃশংসভাবে খুন হলেন শুধু একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য।
যুবলীগের কিছু নেতার ক্যাসিনো সাম্রাজ্য, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন ছাত্রলীগ বা যুবলীগ আওয়ামী লীগের কোন কাজে লাগে? প্রধামন্ত্রীর সব ভালো কাজ জনতার দরবারে ম্লান হয়ে যায় এদের কাণ্ডে। বুয়েটের এই ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবে পুরো ছাত্ররাজনীতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে ‘কী প্রয়োজন ছাত্ররাজনীতির?’
খুন, সহিংসতা, হানাহানি আর রাজনীতির সমার্থক হয়ে ওঠা সামাজিক অমঙ্গল। আমরা সাধারণ মানুষেরা সামগ্রিক সচেতনতার দিকে এগিয়ে না গিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আর চারপাশের ব্যবস্থা ক্রমে পরিবর্তন হতে হতে এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের শিকার হলেও আমাদের বিরোধিতার সুর একরকম শোনাচ্ছে না। একটি অতি বিভাজিত সমাজে হয়তো এটাই স্বাভাবিক।
দেশের বর্তমান সাংবিধানিক আইন অনুসারে আঠারো বছর বয়স হলেই যেকোনও নাগরিক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের মতামতের মূল্য সমান। সেই বিবেচনায় রাজনীতি ছাত্র-ছাত্রীরা করবেই। কিন্তু কী সেই রাজনীতি? পশ্চিমা সমাজে ছাত্রছাত্রীরা যথেষ্ট রাজনীতি করে। সেখানে রীতিমতো ছাত্র আন্দোলন হয়, ছাত্র ধর্মঘটও হয়। কিন্তু যা হয় না তা হলো ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি। আমাদের সমস্যা আমাদের ছাত্রজীবনে দলীয় রাজনীতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ। রাজনৈতিক দলের কাছে ছাত্র সংগঠন লেজুড়ে পরিণত হওয়ার কারণে ক্যাম্পাসে দলাদলি, বিশৃঙ্খলা আর হিংসা প্রবলভাবে বেড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ছাত্ররাজনীতিতে দলীয় প্রভাব কমলে সহিংসতা কমবে, চাঁদাবাজির সংস্কৃতি বন্ধ হবে, আধিপত্যের লড়াই কমবে। দিনে দিনে বড় হয়ে ওঠা সমস্যার চটজলদি সমাধান নেই, কিন্তু একটা রাজনৈতিক দলের কোনও অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকবে না, আর এমন একটা উদ্যোগ সরকার নিতে পারে এখনই।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

No comments:

Post a Comment