Responsive Ads for Rent

Saturday 12 October 2019

আবরার ও রাষ্ট্রের বিবেক

 
 সাহাব এনাম খান
‘আবরার’– এই নামটি এখন আর কোনও সাধারণ নাম নয়। আবরারকে বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের রূঢ়, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি প্রতীকী নাম হিসেবেই আমি দেখি। আবরারের মৃত্যু আমাদের বিস্মিত করে না, শুধু মনে করিয়ে দেয় আমাদের সৃষ্টি করা অমানবিক, অসহিষ্ণু সমাজের কথা। আবরারের মৃত্যুতে তার পিতামাতার বেদনার কিছুটা হয়তো বা তার সহপাঠী, বন্ধু, আর শিক্ষকরা অনুভব করতে পারবেন, এর বাইরে যারা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী এবং সেই দায়ী ব্যক্তিদের যারা পৃষ্ঠপোষক তারা কিছু অনুভব করেন কিনা আমার জানা নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তারাই এই রাষ্ট্রের মানবিক মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তার মৃত্যু আমাকেও স্পর্শ করে এবং এ মৃত্যুর দায় আমার মতে কোনও শিক্ষকই এড়িয়ে যেতে পারেন না।
A
A
আবরার হয়তো একদিন বড় প্রকৌশলী হতে পারতো, হয়তো বা সরকারের বড় পদস্থ হতে পারতো, হয়তো বা শুধু একজন ভালো মানুষ হিসেবেই সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখে যেত। ফেসবুকে তার বাংলাদেশ-ভারতকে নিয়ে চিন্তা আমাদের যুবসমাজের মুক্তচিন্তাভিত্তিক গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহরই প্রকাশ। এত অল্প বয়সে রাষ্ট্রের নীতি নিয়ে তার চিন্তার বিস্তার আমাদের মুগ্ধ করেছে। তার মতের সঙ্গে সবার মিল থাকতে হবে এমন কোনও আইন বা সাংবিধানিক বাধা রাষ্ট্র দেয় না। তার হত্যাকারীরা হয়তো বাকিদের বাকস্বাধীনতা রোধের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছে। এটি সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবিরোধী বর্তমান অবস্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার শামিল। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ যত ওপরে ওঠে, তত ভদ্র হতে হয়, হাম্বল হতে হয়। আর আমাদের হয় উল্টোটা। এটা হয় তখনই, যখন হঠাৎ করে পয়সার জোরে নিচ থেকে অনেক ওপরে যায়, তখন তারা ভাবে ‘মুই কী হনুরে’। সমাজের এই জায়গাটায় একটি আঘাত দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের বাহাদুরি, সে সম্পদের শো-অফ করা, আর যারা সৎপথে চলবে, তারা একেবারে মরে থাকবে, এটা তো হতে পারে না।’
A
তবে এটা পরিষ্কার, আমি যে সমাজে বসবাস করি এবং যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ, সেই সমাজ বা রাজনীতি আবরারের মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে না। তোষামোদকারী ছাড়া কারোরই এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই বিষয়টিকে অযথা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই।
A
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ছাত্র আন্দোলনগুলোতে তো সর্বসাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছিলেন, তাই সাধারণ মানুষ-ই ছাত্র নেতৃত্বকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। ভেবে দেখার সময় এসেছে আদতে সাধারণ মানুষ এই ছাত্র রাজনীতিতে কতটুকু ভরসা রাখেন এবং পিতামাতা যারা তাদের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াতে পাঠান তারা কতটুকু নিশ্চিন্ত থাকেন। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে অসাধারণ মেধাবী শিক্ষকরা যথাযথ জ্ঞান বিতরণ ও শিক্ষার পরিবেশের মাধ্যমে এই আন্দোলনগুলোর জন্য যোগ্য নেতৃত্ব এবং মেধাবী কর্মী তৈরি করে দিয়েছিলেন। এর সুফল এই জাতি পেয়েছে।
A
দুর্ভাগ্যজনক হলেও, নব্বইয়ের দশকের পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো গঠনমূলক কাজের উদাহরণ সাংগঠনিক দলগুলো দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনগুলোর নৈতিক অবক্ষয় এবং এর প্রাসঙ্গিকতার অভাব বাংলাদেশের মানুষ অনেক দিন ধরেই অনুভব করছেন। তাই, ছাত্রলীগ বা যুবলীগের মতো ঐতিহাসিক অঙ্গসংগঠনগুলোর ‘সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে আখ্যা পাওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ইতিহাসের পাতায় শুধু কালো আর লাল কালির দাগই পাওয়া এখন যায়।
A
২০০২ সালে শামসুন্নাহার হলে পুলিশি হামলার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অধ্যাপক চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীদের সমাগম ঘটে। ২০১২ সালে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, ছাত্রলীগের অঞ্চলভিত্তিক অংশকে মদত, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সে সময়ে ছাত্রলীগ নেতাদের হামলায় সংগঠনটির অন্য অংশের কর্মী ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ নিহত হওয়ার পরে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ জনগণের এক অভূতপূর্ব সম্মিলনে। এই আন্দোলনের মধ্যে যখন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক স্বার্থবাদী কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন ঘটা শুরু করে তখন এই আন্দোলনটি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নও তৈরি করে।
A
নিরাপদ সড়কের জন্য যৌক্তিক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভ্যাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অথবা কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রত্যেকটিতেই ছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ। সাংগঠনিক রাজনীতির যথার্থ ভূমিকা এখানে খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর। এসব আন্দোলন এতটাই সরল ছিল, যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা যেত। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এখানে বল প্রয়োগ করার মতো অবস্থায় না নিয়ে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা প্রশাসনিক দক্ষতা কি ছিল না?
A
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে জুবায়েরের মৃত্যুতে আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় যেমন কিছুই শিখিনি তেমনি বাংলাদেশের গর্ব বুয়েটের ছাত্র আবরারের মৃত্যু থেকেও আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় খুব বেশি পরিবর্তন আসবে বলে আশা করি না। নিশ্চিতভাবেই এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, উপদেশ বাণী, ব্যাপক পরিবর্তনের আশ্বাস, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতিতে অতীতে কার কী ভূমিকা ছিল, এমনকি যারা এ ধরনের রাজনীতিকে সমর্থন দিয়ে আসছেন তাদের কাছ থেকেও বিস্তর আশার কথা আমরা শুনবো। এতে মূল অবস্থার পরিবর্তন হবে না, তবে কিছু কসমেটিক লেভেলের আইনি এবং এডহক রাজনৈতিক সমাধান আমরা দেখবো। এর মানে হলো, শিক্ষাঙ্গনে পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রিফর্ম এবং ছাত্র রাজনীতির ব্যাপক সংস্কার করার মতো টেকসই রাজনৈতিক পরিকল্পনা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার প্রতিফলন ঘটানোর মতো প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক নিষ্ঠার অভাব আছে।
A
জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যাদের আইন প্রয়োগ এবং প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা আদতে প্রধানমন্ত্রীকে কতটুকু বাস্তবসম্মত সহায়তা করেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। প্রতিটি সাধারণ নাগরিক বিষয়েই যদি সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এবং রাষ্ট্রের হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রয়োজন হয় তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ বা সরকারি কর্মচারীদের যোগ্যতা ও নিষ্ঠা নিয়ে ভেবে দেখা দরকার। দুই জন ছাত্রলীগ নেতার অপসারণ যে যথেষ্ট নয় তা আবরারের মৃত্যুই প্রমাণ করে।
A
যুবলীগ সভাপতির বয়স পত্রপত্রিকা অনুযায়ী ৭০-এর ওপরে এবং তাদের অনৈতিক কার্যক্রমের পরিধি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হতাশ এবং বিস্মিত করেছে। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ দায়ী। প্রথমটি হলো তোষামোদ, অনৈতিক আর্থিক সুবিধা আদায় ও বল প্রয়োগের রাজনীতি। তোষামোদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় দুর্বলতার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি অনেকটাই তোষামোদ কেন্দ্রিক। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু আনুগত্যপ্রবণ ‘বুদ্ধিজীবী’ ও ‘মিডিয়া’ শ্রেণি, যারা বিভিন্নভাবে কলুষিত ছাত্র রাজনীতিকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদত দিয়ে আসছেন। এটা আরও ভয়ঙ্কর। এরা ভুলকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে বিভ্রান্ত করেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই সত্য গোপন করেন। এটাকে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি বলা যায়।
A
দ্বিতীয়টি হলো রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যবহারের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় ভোট ব্যাংক তৈরি করার জন্য অনেক সময় শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, এবং হালে তো আমরা দেখছিই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনগুলোর কার্যকলাপের নমুনা। এদের কার্যকলাপের সঙ্গে বা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংখ্যাগুরু শিক্ষক কোনও অবস্থাতেই যুক্ত থাকেন না। এই ভোট ব্যাংকের উদ্দেশ্যটাই হলো যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলনকে বা শিক্ষকদের ডিসেন্ট দেওয়ার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা। অতীত ইতিহাসে সরকার পরিবর্তন, রাজনৈতিক মেরুকরণ, বলাই বাহুল্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মতো মহান কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অসামান্য ভূমিকা যেকোনও রাজনৈতিক দলের জন্যই নব্বই পরবর্তী দশকে হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। ফলে, একশ্রেণির শিক্ষক দুর্নীতি এবং ক্ষমতাপরায়ণ আমলা-রাজনীতিবিদের সাথে যুক্ত হয়ে দুষ্টুচক্র সৃষ্টি করেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিষয়টিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। জুবায়ের এবং আবরারের মৃত্যু দুষ্টচক্রের কার্যকলাপেরই ছোট একটি উদাহরণ মাত্র।
A
অতি উৎসাহী দলীয়করণে সাময়িকভাবে কোনও একটি দল হয়তো বা লাভবান হয় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে, রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থার অভাব ঘটে, এবং সিভিল ও সামাজিক আনরেস্টের দিকে সমাজ ধাবিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি অনুধাবন করেছেন বলেই ব্যাপক আকারে শুদ্ধি অভিযান বাংলাদেশে চলছে। বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, টকশোতে দলীয় তোষামোদকারীদেরও এ শুদ্ধি প্রক্রিয়ার আওতায় আনা উচিত। গঠনমূলক সমালোচনা সকলের জন্যই মঙ্গল কিন্তু বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং যুক্তি অমঙ্গলই ঘটায়।
A
ওপরের দুটো বিষয়ই বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অগ্রগতির গতি-প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়াকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যে পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুদ্ধি অভিযান সম্পূর্ণ না হবে এবং তোষামোদ ও শক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির পরিবর্তে মেধাভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তন না হবে, সে পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনীতির বাইরে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির পরিবেশ আরও বেদনাবহ।
A
এই বাস্তবতায় দুটি বিকল্প চিন্তা পাবলিক প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো, বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করা। কারণ, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক পরিবর্তন ও সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন। বুয়েটের মতোই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও হলে হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে রাখা হয়। তাই বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে প্রধানমন্ত্রীর শুরু করা শুদ্ধি অভিযান চলাকালে সাংগঠনিক লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা শ্রেয়। বিএনপি-জামায়াত বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এই সুযোগে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় দখল করবে, অতীতে ছাত্রলীগ মার খেয়েছে ইত্যাদি অতি ব্যবহৃত যুক্তিগুলোর সামাজিক আপিল অনেক আগেই হ্রাস পেয়েছে। অথবা ১৫ বছর আগের বিএনপি যে নির্যাতন করেছিল তা নিয়ে তুলনা করে যুক্তি দেওয়া হয়। বিএনপি বা শিবির সন্ত্রাস করেছিল বলেই ২০০৮ সালে মানুষ এই সরকারকে নির্বাচিত করে। ছাত্রলীগ বিএনপি বা শিবির যা করেছিল সেটার পুনরাবৃত্তি করবে সেই ম্যান্ডেট মানুষ সরকারকে দেয়নি। এটা মনে রাখা দরকার।
A
রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের জনগণ উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অবস্থান সুস্পষ্টভাবেই দুর্বল। এহেন বাস্তবতায় অচল যুক্তি দিয়ে সন্ত্রাসকে পরোক্ষ প্রশ্রয় দেওয়ার অপচেষ্টা ও সাধারণ মানুষকে বিরক্ত করার প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। এ ধরনের যুক্তি সাধারণ মানুষের সাধারণ বোধকে আহত করে। বরং অনেক গবেষণায় দেখা গেছে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং মত প্রকাশের বাধা যুব সমাজের একটি অংশকে ধর্মীয় উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দেয়। যারা রেডিক্যালাইজেশন বা এক্সট্রিমিজম বা ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে কাজ করেন তারা বলতে পারবেন রাজনৈতিক নিগ্রহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আতঙ্কজনক পরিবেশের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই উগ্রপন্থী মতাদর্শে বা বিকল্প আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
A
সাংগঠনিক রাজনীতি যদি উগ্রবাদের পরিবেশকে তৈরি করে দেয় তাহলে রাজনৈতিক উন্নয়ন হবে কী করে? বিষয়টা সরাসরি সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। র্যাাব বা সিটিটিসিইউ’র সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানগুলোতে যেসব যুবক আটক হয়েছে বা যারা সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হয় তাদের অনেকেই শিক্ষিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জুডিশিয়ারি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যোগ্য মানবসম্পদের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে এ ধরনের অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
A
দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো, সাংগঠনিক রাজনীতির ওপর থেকে সরাসরি দলীয় সহায়তা তুলে নিয়ে তাদের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক নৈতিক রাজনীতি করার পথ করে দেওয়া। একই সঙ্গে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের রাজনৈতিক ভাবনা ও মত প্রকাশের স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া দরকার। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ও মিডিয়াকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো এবং ছাত্রছাত্রীদের নির্ভীকভাবে মুক্ত রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য উন্মুক্ত রাজনীতির ব্যবস্থা বেশি কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে শুধু মেধাভিত্তিক শিক্ষকদের সহায়তায় এই ব্যবস্থাটি করা প্রয়োজন।
A
শিক্ষার্থীরা কোন দলকে এবং নীতিকে ধারণ করবেন সেটা তাদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। জোর করে অর্পণ করা আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। এটাই আমরা দেখছি। এখানে উল্লেখ্য, আবরারের মৃত্যুর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও জাতীয় স্বার্থও জড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা এটা কখনও দেখিনি। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অতি সাধারণ দাবিগুলোর মধ্যে আমরা আমাদের অযোগ্যতা ঢাকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য ষড়যন্ত্রের মন্ত্র খুঁজে বেড়াই। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সংস্কৃতি থেকে বের আসার সময় এখন। ষড়যন্ত্রের মন্ত্র না খুঁজে বরং বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের দাবির ওপর আস্থা রাখা দরকার। কারণ, এদের বেশিরভাগই দেশের সেরা মেধাবী সন্তান। তাই বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তার জায়গা করে দেয়া এখন সময়ের প্রয়োজন। এ বিষয়টি আমরা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবো ততই মঙ্গল। অন্যথায় আমি মোমবাতি হাতে শুধু অন্ধকার দেখি।
A
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

কাঠগড়ায় রাজনীতি!


  রেজানুর রহমান
সারাদেশে এখন একটাই খবর—সম্রাট গ্রেফতার হয়েছেন। স্বস্তিকর খবর হলো—সম্রাটেরাও শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হন। সম্রাট। নামের মতো প্রভাব-প্রতিপত্তিতেও তিনি সম্রাট ছিলেন। গ্রেফতারের পর সম্রাটকে ঘিরে যে ধরনের কেচ্ছা-কাহিনি প্রকাশ হচ্ছে, তা যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। তিনি করেছেন রাজনীতি। কিন্তু সেটা ছিল তার প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে তোলার পাশাপাশি অন্ধকার জগতের সম্রাট হওয়ার একমাত্র খুঁটি। রাজনীতিকে তিনি অন্যায় ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, শুধু সম্রাটই নন, রাজনীতিকে আরও অনেকেই স্রেফ ব্যবসা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে তোলার বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং এখনও করছেন। এমন আরও তথ্য হয়তো মিলবে। যে কারণে ‘রাজনীতি’ শব্দটিই যেন এখন কাঠগড়ার অপরাধী। অথচ এই রাজনীতিই প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল।
A
প্রিয় পাঠক, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, মারাত্মক অপরাধ এমনকি খুন করার পরও যদি কেউ গ্রেফতার হন, তাকে বা তাদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য পরিবারের লোকেরা উঠেপড়ে লেগে যান। শ্রদ্ধাভাজন আইনজীবীদের মধ্যেও অনেকে অপরাধীর পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করেন। আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে খুনের মামলার আসামিও অনেক সময় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
এই প্রথম দেখলাম একজন অপরাধীর পরিবারেরই একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অপরাধীর সাজা চেয়েছেন। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন বলেছেন, ‘আমার স্বামী যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে তার সাজা হওয়া উচিত। প্রসঙ্গক্রমে শারমিন বলেছেন, এখন যুগ পাল্টেছে। বিনে পয়সায় এখন আর কেউ মিছিলে আসে না। সম্রাট যা আয় করতো, তার একটা বড় অংশ মিছিলে লোক আনার জন্য খরচ করতো।’
শারমিন চৌধুরীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অনেকে হয়তো সম্রাটের প্রতি অনুকম্পা দেখাতে চাইবেন। এক্ষেত্রে নানাজনের নানান মত থাকতেই পারে। কিন্তু একথা তো সত্য, সম্রাট রাজনীতিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। একসময় হয়তো মিছিল মিটিংয়ে লোক জড়ো করেই দলের নেতাদের সুনজরে পড়ে যান এবং এই ‘সুনজরকেই’ পুঁজি বানিয়ে আজকের সম্রাটে পরিণত হন। শুধু সম্রাটই নন, মিছিল-মিটিংয়ে বেশি বেশি লোক আনতে পারার যোগ্যতায় আজ অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে গেছেন। যদিও এখন আর সেই সুযোগ নেই। কারণ দেশে এখন আর মিছিল মিটিংয়ের তেমন একটা দরকার পড়ে না।
প্রিয় পাঠক, একটা চমকপ্রদ তথ্য দেই আপনাদের। আপনি সভা অথবা সেমিনার করবেন। দর্শক দরকার? ফেল কড়ি মাখো তেল। টাকা দিলেই দর্শক পেয়ে যাবেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় প্রতিদিন কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল অথবা সংগঠনের সভা-সমাবেশ লেগেই থাকে। হাততালি দেওয়ার জন্য লোক দরকার? চিন্তার কোনও কারণ নেই। প্রেস ক্লাবের সামনে গেলেই উপযুক্ত লোক পেয়ে যাবেন। শুধু আওয়াজ দেবেন, অডিয়েন্স চাই। দেখবেন একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি এসে হাজির হবেন। শুধু বলবেন আপনার কতজন অডিয়েন্স দরকার। অবশ্য সভা-সমাবেশের আকার-প্রকারভেদে জনপ্রতি অডিয়েন্সের ভাড়া নির্ধারিত হয়। রাস্তার সমাবেশের ভাড়া এক ধরনের। সেমিনারে যোগ দেওয়ার ভাড়া অন্য ধরনের। আর যদি সেমিনারে খাবারের প্যাকেট পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, তাহলে জনপ্রতি ভাড়ার পরিমাণ কমে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ‘জোগানদার’ বললেন, “এখন আর সেই দিন নেই। দেশের পরিস্থিতি ভালো। তাই এখন আর তেমন মিছিল মিটিং হয় না। একপর্যায়ে গর্বের ভঙ্গিতে বললেন, এখন যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতা তাদের অনেককেই আমি ‘অডিয়েন্স’ সাপ্লাই দিছি। মিছিল মিটিংয়ে লোক ভাড়া কইর্যা আনছি। এখনও মাঝে মাঝে অনেক নেতা আমার কাছে সংবাদ পাঠায়। মিছিল মিটিংয়ের জন্য ‘অডিয়েন্স’ চায়। সাধ্যমতো জোগাড় কইর্যা দেই। তবে মানুষ এখন অনেক চালাক হইয়া গেছে। সরকারি দলের মিছিল মিটিং হইলে ভাড়া বেশি চায়।”
জোগানদার পরিচয়ের এই লোকটিকে প্রশ্ন করেছিলাম, মিছিল মিটিংয়ে লোক ভাড়া করতে হয় কেন? দলকে যারা ভালোবাসে তারা তো এমনিতেই মিছিল মিটিংয়ে আসার কথা। তারা কি আসে না?
জোগানদার লোকটি মৃদু হেসে বলল, “সেই দিন আর এখন নাই। টাকা ছাড়া কেউ এক পাও আগায় না। ভাই, ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি। এখন অনেকেই আদর্শের জন্য রাজনীতি করে না। পাওয়ারের জন্য রাজনীতি করে। আপনার রাজনৈতিক পাওয়ার আছে। চিন্তার কিছু নাই। চাঁদার টাকা এমনিতেই হাতে আসবে। গ্রামে-গঞ্জে গেলে দেখবেন রাস্তার দুই ধারে শুধু স্থানীয় নেতাদেরই ছবি। ডিজিটাল যুগ। নিজের চেহারাসহ ব্যানার ফেস্টুন বানানো খুবই সহজ। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শের ‘আ’ সম্পর্কেও অনেকের কোনও ধারণা নাই। রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেই একটা পাওয়ার পাওয়া যাবে। এবং সেই পাওয়ারের আশায় ছুটছে অনেকে। তাদের অনেকেরই আইডল সম্রাটের মতো নেতারা।”
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে সম্রাটকে গ্রেফতার করার পর যখন তাকে ঢাকায় কাকরাইলে তার অফিসে নিয়ে আসা হয়, তখন গোটা এলাকায় উৎসুখ মানুষের ভিড় দেখা দেয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল সম্রাটের অনুগত কর্মী। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তাদের অনেকের প্রতিক্রিয়া শুনে যারপরনাই অবাক হয়েছি। একজন তো সম্রাটকে মহান নেতা বানিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাই কিন্তু সাধারণ মানুষের অনেক উপকার করতেন।’ তার মানে ঘটনা কী দাঁড়ালো? ঈদ অথবা এ ধরনের কোনও অনুষ্ঠান উপলক্ষে ৫০-১০০ অসহায় মানুষের হাতে সাহায্য তুলে দেওয়া মানেই কি ভালো কাজ করা? সম্রাট মাঝে মাঝে এভাবে দুস্থ মানুষকে সাহায্য করতেন। শুধু সম্রাটই নন, তার মতো আরও যারা আছেন তারাও এভাবে দুস্থ মানুষকে সাহায্য করেন। কেন করেন? এটাও এক ধরনের রাজনীতি। সাধারণ মানুষ যাতে মনে করে আহা নেতা কত ভালো! কিন্তু ভেতরে ভেতরে এ ধরনের নেতারা যে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন, সেটা অনেকেই জানে না। সম্রাট গ্রেফতার না হলে হয়তো তার সম্পর্কেও এত কথা জানা হতো না।
প্রচার মাধ্যমেই জানলাম মালয়েশিয়ায় সম্রাটের একজন বান্ধবী আছে। শুধু তার জন্মদিন পালন করার জন্য দেড় কোটি টাকা দিয়ে একটি প্রমোদতরী ভাড়া করেছিলেন সম্রাট। সিন্ডলিং নামের ওই মালয়েশিয়ান তরুণীর জন্মদিনের পার্টিতে সম্রাটসহ অবৈধ ক্যাসিনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তার অন্যান্য বন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের একটি ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই যে সম্রাটরা রাজনৈতিক পরিচয়ে এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠলেন, তার জন্য দায়ী কে? গুটিকয়েক বিপথগামী তথাকথিত নেতার কারণে রাজনীতির মতো অতি প্রিয় শব্দটি যে কাঠগড়ায় দাঁড়াল, তার দায়ভার কার?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

সৌদি-ইরান বিরোধ কবে থামবে


  আনিস আলমগীর
সৌদি আরব এবং ইরান দু’টি বৃহত্তম মুসলিম দেশ। উভয় রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক এবং মুসলিম উম্মাহর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মর্যাদাশালী রাষ্ট্র। মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফের অবস্থানের কারণে সৌদি আরব মুসলমানদের কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছে। সৌদি আরবের লোকসংখ্যা কম হলেও বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী। তবে সমগ্র অঞ্চল প্রায় মরুভূমি। সৌদির ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তন, লোকসংখ্যা মাত্র তিন কোটি ২০ লাখ। ইরানের আয়তন প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার, লোকসংখ্যা ৮ কোটি মাত্র। উভয় দেশে সম্পদের ঈর্ষণীয় প্রাচুর্য রয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তেলের মজুত সৌদি আরবে, আর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাসের মজুত ইরানে। আবার তেল-গ্যাস উভয় সম্পদের ক্ষেত্রেও দেশ দুটি বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে আছে।
A
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর সম্রাট রেজা শাহ পাহলভীর পতন হয়। ইরান বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কোম শহরের ইসলামী পণ্ডিতেরা। মূল নেতা ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তিনি ইরান সম্রাটের কোপানলে পড়ে ১৫ বছর ধরে ইরাক ও ফ্রান্সে নির্বাসনে ছিলেন। ফ্রান্স থেকেই তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কোমের আয়াতুল্লাহরা সবাই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সুতরাং পাহলভী সম্রাট রেজা শাহ পাহলভীর পতনের পর থেকে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক ছিল না। এখনো নেই।
ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের মূল দুটি ধারা হচ্ছে—শিয়া ও সুন্নি। ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক শিয়া আর সৌদি আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক সুন্নি। উভয় দেশে যে সংখ্যালঘু শিয়া ও সুন্নি নেই, তাও নয়। সৌদি আরবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ শিয়া আর ইরানে সুন্নির সংখ্যাও ১০ শতাংশ। ইরানের পার্লামেন্ট বা মজলিসে ফেরকাগতভাবে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা আছে। এমনকি ইরানে কিছু ইহুদিও বসবাস করে এবং তাদেরও মজলিসে প্রতিনিধিত্ব আছে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় কোমের মাওলানারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা।
ইরান আর সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন খুবই খারাপ। ২০১৬ সাল থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যন্ত নেই দুই দেশের মধ্যে। ধর্মীয় ফেরকার বাইরে দুই দেশের সম্পর্কের তিক্ততার মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার, আমেরিকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদিদের দহরম মহরমও অন্যতম। ১৯৮০ থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর সাদ্দাম হোসেনের কাঁধে বন্দুক রেখে সৌদি আরব-আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। সৌদি আরব ইরাককে অর্থ দিয়েছে, আর আমেরিকা অস্ত্র দিয়েছে সেই যুদ্ধে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ ছিল ইরানের বিরুদ্ধে। তারপরও ইরানকে পরাস্ত করা যায়নি। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইরান যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছিল।
সৌদি আরব-ইরানের তিক্ত সম্পর্কের সাম্প্রতিক আরেকটি কারণ হচ্ছে ইয়েমেন। ইয়েমেন সৌদি আরবের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক জনপদ। কোরআন, বাইবেল এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে ইয়েমেনের কথা উল্লেখ আছে বারবার। ইয়েমেনই ছিল রানি বিলকিসের রাজ্য। বাদশা সোলায়মান জেরুজালেম থেকে আকাশপথে সাবা এসেছিলেন, রানি বিলকিসের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
ইয়েমেনের সঙ্গে ইরানের কোনও স্থল সীমানা নেই। ইয়েমেনের উত্তরে সৌদি আরব, দক্ষিণে এডেন উপসাগর। পূর্বে ওমান আর পশ্চিমে লোহিত সাগর। আয়তন ৫ লাখ ২৭ হাজার ৯৬৮ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা দুই কোটি ৮০ লাখ। এখানে শিয়া-সুন্নি প্রায় সমান। সেখানকার হুথি বিদ্রোহীরা যাইডি শিয়া। হুথিরা শিয়া হলেও সুন্নিদের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য ইরানি শিয়াদের মতো ব্যাপক নয়। ইয়েমেনের রাজধানী সানা। এডেন হচ্ছে বড় সামুদ্রিক বন্দর। লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে প্রাচীনকাল থেকে এই বন্দরের গুরুত্ব খুবই বেশি।
২০১১ সালে আরব-বসন্তের সময় ইয়েমেনেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ বিক্ষোভের তোড়ে পদত্যাগ করেন। তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়। ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাইস প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদি ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাদিকে অনেক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। আল কায়েদার হামলা, দক্ষিণে বিছিন্নতাবাতী আন্দোলন, সালেহের প্রতি অনেক সামরিক কর্মকর্তার আনুগত্য। এর বাইরে দুর্নীতি, বেকারত্ব আর খাদ্য সংকট। আর নতুন প্রেসিডেন্টের দুর্বলতার সুযোগে ইয়েমেনের যাইডি শিয়া মুসলিম নেতৃত্বের হুথি আন্দোলনের কর্মীরা সাডা প্রদেশ এবং আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ সময় অনেক সুন্নিও তাদের সমর্থন জোগায়। এরপর বিদ্রোহীরা সানা অঞ্চলেরও নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে হাদি পদত্যাগে বাধ্য হন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সালেহের সমর্থক এবং হুথিরা মিলে তাকে গৃহবন্দি করে। হাদি পালিয়ে এডেন চলে যান এবং হুথিদের ক্ষমতাগ্রহণকে অমান্য করে এডেনকে রাজধানী ঘোষণা করেন। হুথি আর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহের প্রতি অনুগত। এরপর তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের পেছনে ইরান সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। ২৫ মার্চ ২০১৫ গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আর টিকতে না পেরে হাদি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। হাদিকে ইয়েমেনে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে সৌদি আরব আর অন্য আটটি সুন্নি দেশ একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। এই জোটকে লজিস্টিক আর ইন্টেলিজেন্স সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স।
২০১৫ সাল থেকে সৌদি বাহিনী বারবার ইয়েমেনের আকাশপথে, স্থলপথে আক্রমণ করে এবং কোনও জাহাজ যেন বন্দরে ভিড়তে না পারে তার প্রতি দৃষ্টি রাখে। তাতে ইয়েমেনে আকাল লেগে আছে। হাজার হাজার ইয়েমেনি শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এবং মারা যাচ্ছে। বিশ্বের মানবতাবাদী সংগঠনগুলো সৌদি আররকে বন্দরে বোম্বিং না করার আহ্বান রেখেছে। তাতে কোনও ফল হচ্ছে না। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর আমেরিকা এখন জোট বেঁধে হুথিদের মোকাবিলা করছে, তবুও হুথিদের নিঃশেষ করা যাচ্ছে না। সৌদি আরব ও আমেরিকার অভিযোগ—হুথিদের সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে ইরান।
হুথিরা ড্রোন হামলা করে গত সপ্তাহে সৌদির এক তেলক্ষেত্রের প্রচুর ক্ষতি সাধন করেছে। এখন সৌদির তেল উত্তোলন অর্ধেকে নেমে এসেছে। সৌদি আরব বলেছে, হামলা ইরান করেছে। ইরান তা অস্বীকার করেছে। আসলে এত সুনিপুণ আক্রমণ হুথিদের দ্বারা সম্ভব হলো কীভাবে? ২৮ সেপ্টেম্বর হুথিরা এসব কথার জবাব দিয়েছে। এবার আক্রমণ করেছে প্রচণ্ডভাবে, তাতে সৌদিরা নির্বাক হওয়ার কথা। হুথিরা বলেছে সৌদিরা ইয়েমেনে গণহত্যা বন্ধ না করলে তারা আরও ব্যাপক হামলা পরিচালনা করবে।
২৮ সেপ্টেম্বর হুথিরা সৌদি আরবের অভ্যন্তরে যে হামলা চালিয়েছে, তা তেলক্ষেত্র হামলার চেয়েও মারাত্মক। ইয়েমেনি বাহিনী এবং হুথিরা সৌদি বাহিনীকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যেতে প্ররোচিত করেছিল। অতঃপর সৌদি ভূখণ্ডে ইয়েমেনি বাহিনী এবং হুথিরা ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে সৌদি বাহিনীকে খুবই নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছিল। হুথিরা নাজরান শহর ও আশপাশের এলাকা ঘিরে ফেলেছিল। এ অভিযানে তারা প্রচুর সৌদি সৈন্য আটক করে এবং হাজার হাজার সামরিক যান ও অস্ত্র হুথিদের হস্তগত হয়।
এই অভিযানের আগে অনতিদূরে বিমানবন্দর ধ্বংস করে দিয়েছিল, যে কারণে সৌদি বিমান এই আক্রমণে সৈন্যবাহিনীকে সহযোগিতা দিতে আসতে পারেনি। এটি একটি মোড় পরিবর্তনকারী অভিযান। যুক্তরাষ্ট্রের বা সৌদি আরবের আর কোনও সুযোগ রইল না এটাতে ইরানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলার। হুথিরা রিয়াদে কিং খালেদ বিমানবন্দরেও হামলা চালিয়েছিল।
সম্ভবত এসব হামলার কারণে সৌদি জোট ইয়েমেনের শক্তিকে আর খাটো করে দেখছে না। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এখন প্রস্তাব করেছেন ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করার চেয়েও রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানো উত্তম হবে। সৌদি আরব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ইরানের সঙ্গে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল। ইমরান খান মধ্যস্থতার ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছেন। রাজকুমারের এই প্রস্তাবকে ইরান স্বাগত জানিয়েছে। সৌদিরা ইরানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে দহরম-মহরম আরম্ভ করেছিল। তাদের সে প্রয়াসকে মুসলিম বিশ্ব ভালো চোখে দেখেনি।
সৌদি আরবের চিন্তা সম্ভবত তার সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ইয়েমেনে শিয়া মতাবলম্বীদের একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকলে হয়তো তার অসুবিধা হতে পারে। সেজন্য তো ইয়েমেনে হাজার হাজার বোমা নিক্ষেপ করে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যা করা সৌদির উচিত হয়নি। দীর্ঘদিন তাদের বন্দরে কোনও জাহাজ নোঙর করতে পারছে না। সৌদিদের বিমান আক্রমণের ভয়ে হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে মরছে আর ইয়েমেনিরা মরছে অনাহারে। জাতিসংঘ বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে।
মুসলিম বিশ্ব সৌদি আরবকে ভ্যাটিকানের ভূমিকায় দেখতে চায়। সৌদি আরবের উচিত নিজেকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করা। তাদের মনে রাখা দরকার তারা হেরেমাইনের খাদেম। অমানবীয় যে কোনও কাজ তাদের জন্য অশোভনীয়। আমরা আশা করি সৌদি আরব আর ইরান রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সংলাপ শুরু করবে। বিরোধ থামিয়ে শান্তির পথে হাঁটবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.চম

মুক্তচিন্তা ও খুনের জায়েজিকরণ


 আমীন আল রশীদঃঃ
কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ব্লগারদের বিরুদ্ধে যে কিলিং মিশন শুরু করেছিল উগ্রবাদীরা, সেই হত্যাকাণ্ডকে তারা ‘নাস্তিকের বিরুদ্ধে জিহাদ’ বলে জায়েজের চেষ্টা করেছিল। ২০১৩ সালে রাজীবকে খুন করার মধ্য দিয়ে যে ব্লগার হত্যা শুরু হয়, তারপর একে একে খুন হয়েছেন লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ ও নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন। যেদিন দীপনকে রাজধানীর আজিজ মার্কেটে ঢুকে খুন করা হয়, সেদিনই লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে হামলা চালানো হয় লেখক ও এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুর ওপর। শুদ্ধস্বর অভিজিৎ রায়ের বইয়ের অন্যতম প্রকাশক।
A
উগ্রবাদীদের হত্যা জায়েজের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হাতে কেউ খুন হওয়ার পরে তাকে ‘শিবিরকর্মী’ বলে চালিয়ে দেওয়ার কৌশলের মধ্যে খুব বেশি তফাৎ নেই। অর্থাৎ বিষয়টা এরকম, কেউ নাস্তিক হলেই কিংবা শিবিরকর্মী হলেই তাকে খুন করা বৈধ এবং এই সমাজ রাষ্ট্রে ভিন্নমত পোষণকারীর বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। সবশেষ সেই অধিকারবঞ্চিতের তালিকায় যুক্ত ব্যক্তিটির নাম আবরার ফাহাদ, যিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, আবরার ফাহাদ রোববার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। মধ্যরাতে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় তার মরদেহ। এর আগের দিন শনিবার বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে তিনি ফেসবুকে সবশেষ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, যেখানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে তিনি নিজের ভাবনা তুলে ধরেন। আবরার ওই স্ট্যাটাসে যা লিখেছেন, সেখানে কয়েকটা লাইন এরকম : ‘৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনও সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।’
পুলিশ, সহপাঠী ও স্বজনদের বরাতে জানা যাচ্ছে, মূলত এই স্ট্যাটাসের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে রবিবার আবরারকে ধরে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। তারপর তার মোবাইল ফোন চেক করা হয়। এরপর তাকে শিবিরকর্মী সন্দেহে বেধড়ক পেটানো হয়। যাতে মৃত্যু হয় আবরারের।
প্রশ্ন হলো আবরার ফেসবুকে যা লিখেছিলেন সেখানে কি রাষ্ট্রদ্রোহ ছিল, নাকি দেশপ্রেম? যদি তার বক্তব্যে ভারতবিরোধিতার গন্ধও থাকে, তাহলে বলতে হবে সেই বিরোধিতাটুকুর জন্ম দেশপ্রেম থেকেই এবং এটুকু বলার অধিকার যেকোনও নাগরিকের রয়েছে। বরং অনেকেই ফেসবুকে বা বিভিন্ন লেখায় এর চেয়ে অনেক কড়া ভাষা ব্যবহার করেন। কিন্তু আবরারকেই প্রাণ দিতে হলো। কারণ তাকে মেরে ফেলাটা ছাত্রলীগ নেতাদের জন্য সহজ ছিল। এ জাতীয় খুনের পেছনে শুধু যে খুন হওয়া ব্যক্তির কোনও কাজই প্রধান তা নয়, বরং এখানে খুনিদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন এবং তারা যে ‘আনচ্যালেঞ্জড’, এটা বোঝানোও একটা উদ্দেশ্য থাকে। আবার আবরারের মুখে কিছুটা দাড়ি ছিল বলে তাকে সহজেই ‘শিবিরকর্মী’ বলে চালিয়ে দেওয়াটাও যেহেতু সহজ ছিল, ফলে খুনিরা সেই কৌশলটিই নিয়েছিল। কিন্তু পরে যখন কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিকরা জানালেন, আবরারের পরিবারের লোকেরা আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং শিবিরের সঙ্গে আবরারের কোনও সম্পৃক্ততা ছিল না, তখন সেই অপপ্রচারটি আর হালে পানি পায়নি। কিন্তু ধরা যাক আবরার সত্যি সত্যিই শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তারপরও কি ছাত্রলীগকে এই হত্যার অনুমতি দেওয়া আছে? একসময় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিবির যা করতো, যেভাবে প্রতিপক্ষের রগ কেটে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো, সেই একই কাজ যদি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও করেন, তাহলে শিবিরের সঙ্গে তাদের আর কী পার্থক্য থাকে?
তবে বুয়েটের এই ঘটনায় দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—১. ঘটনার পর দ্রুতগতিতে পুলিশ অপরাধীদের আটক করেছে, এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে সিসি ক্যামেরা এবং ২. সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভিন্নমতের কারণে একজন মানুষকে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই।’ দেশের সবচেয়ে বড় এবং ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার মুখ থেকে এরকম বক্তব্যই জাতি আশা করে।
আবরারের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক ফেসবুকে যা লিখেছেন সেখান থেকে কয়েকটা লাইন উদ্ধৃত করা যায়—‘আওয়ামী লীগ যেকোনও বিরুদ্ধমতকে শিবির নামে চালিয়ে তার ওপর হত্যা-নির্যাতন করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করছে দেশে প্রচুর জামায়াত-শিবির রয়েছে।…আর শিবির-স্টিগমার যেরকম ব্যবহার-অপব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে তারা এও প্রমাণ করে ছাড়বে, তাদের তুলনায় শিবির অপেক্ষাকৃত পবিত্র দল।’
তকমার রাজনীতি আমাদের দেশে নতুন কোনও প্রবণতা নয়। অর্থাৎ আমার বক্তব্যের সঙ্গে আপনার বক্তব্য বা ভাবনা না মিললেই আমি আপনার শত্রু। অথচ যেকোনও বিষয়ে দু’জন মানুষের ভাবনা দুরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং এই ভিন্নমতকেই বলা হয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি ও সৌন্দর্য। কিন্তু যেহেতু আমরা মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও অন্তরে এটা লালন করি না, ফলে কেউ যখন কোনও বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, আমরা ধরেই নিই তিনি আমাদের শত্রু। যে কারণে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকারীদের মধ্যে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই জঙ্গিবাদের ভূত দেখেছিলেন। এর অব্যবহিত পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রগতিশীল শিক্ষক, যারা তাদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বা ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের অনেককেই আকারে-ইঙ্গিতে সরকারবিরোধী, বিএনপি-জামায়াতের দোসর ইত্যাদি গালি দেওয়া হয়েছিল।
চলমান রাজনীতি নিয়ে ভিন্নমতের কারণে বিষোদ্গারের শিকার হয়েছেন দেশ-বিদেশের একাধিক স্বনামধন্য অধ্যাপক ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। অথচ তাদের মতামত নিয়ে অ্যাকাডেমিক তর্ক হতে পারতো। কিন্তু রাজনীতির মতো সিরিয়াস ও জনপ্রিয় বিষয়ে অ্যাকাডেমিক তর্কের জায়গাটি এখন দখল করেছে গালাগাল, বিষোদ্গার আর নানাবিধ তকমা, এমনকি শারীরিক আক্রমণ। পরিহাস হলো, যে বিদগ্ধজনদের নানারকম আক্রমণ ও বিষোদ্গার করা হয়েছে, তাদের অনেকেই চিন্তা-চেতনায় প্রগতিশীল; মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে তারা হয় আওয়ামী লীগের সপক্ষের কিংবা বামপন্থী বলে পরিচিত। অর্থাৎ কোনও অর্থেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার মানুষ নন। কিন্তু শুধু ভিন্নমত ও ভিন্ন ভাবনার কারণে তারাও গালাগালের শিকার।
উগ্রবাদীদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে মৃত্যুবরণ করেন প্রথাবিরোধী লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। তিনি লিখেছেন, ‘যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ সম্পর্কে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।’ সুতরাং যে শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের সময় ও সমাজ সম্পর্কে সন্তুষ্ট নন, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, কথা বলেন, যারা বৈষয়িক নানারকম সুবিধা পাওয়ার লোভে রাষ্ট্রযন্ত্রকে তেল দেন না, তারাই মূলত সমাজের অগ্রসর অংশ; তারাই সমাজের সৌন্দর্য, তারাই সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধার পাত্র। একটি সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে এই মানুষগুলোরই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত হওয়ার কথা। মার্কিন সরকারের সবচেয়ে বড় সমালোচক নোয়াম চমস্কি সেদেশের সব দল ও মতের কাছেই গ্রহণযোগ্য এবং সবাই তাকে সমীহ করেন।
কিন্তু সেই সংস্কৃতির চর্চাটি যে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা, সেটি ব্যবহারের জন্য আমরা আদৌ প্রস্তুত কিনা বা যারা এ মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন, তাদের কতজন এই মাধ্যমটি ব্যবহারের যোগ্য, সেই প্রশ্নটিও মাঝেমধ্যে শুনতে হয়। শুধু অল্পশিক্ষিত লোকই নন, উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে সম্মানিত মানুষ হিসেবে পরিচিত অনেক লোকও ফেসবুকে যেসব কথাবার্তা লেখেন, নিজের মতের সঙ্গে না মিললে যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন এবং তকমা লাগিয়ে দেন, তাতে অনেক সময়ই মনে হয়, শিক্ষা-দীক্ষা-পদ-পদবি যাই হোক, মানুষ তার ভেতরটা পাল্টাতে পারে খুব সামান্যই। যদি এই পাল্টানোর ইচ্ছাটা তার নিজের না থাকে।
বাস্তবতা এখন এমন, যারা ফেসবুকে সমসাময়িক নানা বিষয়ে নিজের ভাবনা ও মতামত শেয়ার করেন, তারা সব সময়ই কোনোভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ অথবা তকমার রাজনীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। নিজের মতের সঙ্গে না মিললেই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের লোক অথবা বিরুদ্ধবাদী বলে আখ্যা দেওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবেই যে একটি অসহিষ্ণু সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠছে, ফেসবুক তার একটি বড় আয়না। ফলে এই আয়নায় নিজেদের মুখটি দেখে চিনতে পারা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা শুরুর কোনও বিকল্প নেই—যদি আমরা সত্যিই একটা মানবিক, পরমতসহিষ্ণু এবং গণতান্ত্রিক সমাজের কথা চিন্তা করি। সেইসঙ্গে আমাদের এটিও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার বিকাশ ও নতুন জ্ঞান তৈরির কারখানা; খুনের প্রশিক্ষণকেন্দ্র নয়। ভিন্নমত মানেই তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কিংবা ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার রাষ্ট্র, সংবিধান ও আইন যে কাউকে দেয়নি, সেটি প্রমাণ করতে হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আবরারের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের কোনও বিকল্প নেই।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

ছাত্ররাজনীতি কতটা বাঞ্ছনীয়?


 সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাঃঃ
সহিংসতার জন্য যুক্তি লাগে না, লাগে কেবল একটি উপলক্ষ। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের ফেসবুক পোস্ট ছিল একটি উপলক্ষ মাত্র, আগের বহু ঘটনার মতোই এই ঘটনায়ও আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের ছাত্ররাজনীতি কেবল নিষ্ঠুরতা আর হিংসার পাঠ দেয়, সেটা যে বিদ্যাপীঠই হোক না কেন। এবং আমাদের রাজনীতি এই শিক্ষাও দেয়, যেকোনোভাবেই হোক একটি পর্যায়ে গিয়ে খুনিদের পেছনে একটি গোষ্ঠীর সমর্থন থাকছে এবং থাকবে।
A
‘বেরিয়ে আসছে নির্যাতনের রোমহর্ষক সব ঘটনা’—এই শিরোনামে মঙ্গলবার প্রথম পাতায় দৈনিক সমকাল একটি প্রতিবেদন করেছে। রিপোর্টার লিখেছে, বুয়েটের হলে হলে এক শ্রেণির ছাত্রলীগ নেতার নির্যাতন সেল আছে এবং সেগুলোয় এ পর্যন্ত ঘটেছে শত শত নির্যাতনের ঘটনা। আবরার হত্যার পর ঘটনা সামনে এলো কেবল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব জেনেও নীরবে মেনে নিয়েছে, যেমন করে উপাচার্য তার ছাত্রের জানাজায় না এসে নীরব থেকেছেন নিজ বাড়িতে।
A
কিছু কিছু ঘটনায় হৃদয় যেভাবে সাড়া দেয়, মস্তিষ্ক তাতে ষোলো আনা সায় দিতে পারে না, প্রশ্ন তোলে। জানি এবং মানি, ছাত্ররাজনীতি যারা করে সবাই সমান নয়। কিন্তু একথা কি সবাই মানি, বিদ্বেষের রাজনীতি প্রচারের যে তুমুল ও বহুমুখী প্রচেষ্টা চলছে, তার প্রধান লক্ষ্য দেশের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। নানাভাবে, নানা দিক থেকে এই রাজনীতি তাদের দখল নিতে চায়। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও সেই সর্বগ্রাসী তৎপরতার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি বলে আমরা জানতাম, তার অন্যতম বুয়েট। কিন্তু আমরা ভুল জানতাম।
রাজনীতি যে ক্রমেই বিপরীত মতকে গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে, তা আরও একবার প্রমাণিত হলো। আবরারের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য পাল্টা যুক্তি না দেখিয়ে তাকে টানা সাত ঘণ্টা নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এবং এরা কতটা নির্দয় আর নিষ্ঠুর হলে, খুন করে এসে আরাম করে, ঠান্ডা মাথায় টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতে পারে!
আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে, যারা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি করেন, শিক্ষক বা ছাত্র, অন্যদের তুলনায় তাদের রাজনীতিতে চিন্তার প্রসারতা তুলনামূলক বেশি থাকবে, কারণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মনকে প্রসারিত করা। এমন একটি প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকে দেখলে আমাদের আর কোনও আশার জায়গা থাকে না। কারও মতামত পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু তাকে বলবার সুযোগই দেওয়া যাবে না, এই উগ্রতা সমাজের অগ্রতার প্রশ্নে প্রাণঘাতী।
ছাত্ররাজনীতি কতটা হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে, তার বিপজ্জনক উদাহরণ আবরারের খুন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের ছাত্ররাজনীতিতে সহিংসতার আধিক্য বহু দিনের। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশের নানা প্রান্তে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে যে আতঙ্কের পরিবেশ আমরা দেখছি, তা অভূতপূর্ব। আমরা এতটাই বিভাজিত হয়েছি, পরিস্থিতি যতই অগ্নিগর্ভ হোক, কিছু মানুষের নিকট রাজনৈতিক আনুগত্য বজায় রাখাই অধিকতর জরুরি। তারা বলে চলেছে, যেহেতু পুলিশ খুনিদের আটক করেছে, তাই আন্দোলনের প্রয়োজন নেই, খুনের প্রতিবাদ করার প্রয়োজন নেই।
আজ যা ছাত্রলীগ করছে, আগে তা করেছে ছাত্রদল, শিবির—কম বা বেশি। আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বহু দিন যাবৎ সহিংসতানির্ভর। ইসলামী ছাত্রশিবিরের রগ কাটা থেকে আজকের এই পিটিয়ে হত্যা। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এবার হিংস্রতার মাত্রা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু তা মাত্রার ফারাক মাত্র, চরিত্রের নয়। এবার নতুন কী হলো? আসলে যা নতুন, তা-ই সর্বাধিক উদ্বেগের। এত দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারে লড়াই হতো, মারামারি হতো, এখন এক অতি অপরিচিত অরাজনৈতিক ছাত্র নৃশংসভাবে খুন হলেন শুধু একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য।
যুবলীগের কিছু নেতার ক্যাসিনো সাম্রাজ্য, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন ছাত্রলীগ বা যুবলীগ আওয়ামী লীগের কোন কাজে লাগে? প্রধামন্ত্রীর সব ভালো কাজ জনতার দরবারে ম্লান হয়ে যায় এদের কাণ্ডে। বুয়েটের এই ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবে পুরো ছাত্ররাজনীতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে ‘কী প্রয়োজন ছাত্ররাজনীতির?’
খুন, সহিংসতা, হানাহানি আর রাজনীতির সমার্থক হয়ে ওঠা সামাজিক অমঙ্গল। আমরা সাধারণ মানুষেরা সামগ্রিক সচেতনতার দিকে এগিয়ে না গিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আর চারপাশের ব্যবস্থা ক্রমে পরিবর্তন হতে হতে এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের শিকার হলেও আমাদের বিরোধিতার সুর একরকম শোনাচ্ছে না। একটি অতি বিভাজিত সমাজে হয়তো এটাই স্বাভাবিক।
দেশের বর্তমান সাংবিধানিক আইন অনুসারে আঠারো বছর বয়স হলেই যেকোনও নাগরিক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের মতামতের মূল্য সমান। সেই বিবেচনায় রাজনীতি ছাত্র-ছাত্রীরা করবেই। কিন্তু কী সেই রাজনীতি? পশ্চিমা সমাজে ছাত্রছাত্রীরা যথেষ্ট রাজনীতি করে। সেখানে রীতিমতো ছাত্র আন্দোলন হয়, ছাত্র ধর্মঘটও হয়। কিন্তু যা হয় না তা হলো ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি। আমাদের সমস্যা আমাদের ছাত্রজীবনে দলীয় রাজনীতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ। রাজনৈতিক দলের কাছে ছাত্র সংগঠন লেজুড়ে পরিণত হওয়ার কারণে ক্যাম্পাসে দলাদলি, বিশৃঙ্খলা আর হিংসা প্রবলভাবে বেড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ছাত্ররাজনীতিতে দলীয় প্রভাব কমলে সহিংসতা কমবে, চাঁদাবাজির সংস্কৃতি বন্ধ হবে, আধিপত্যের লড়াই কমবে। দিনে দিনে বড় হয়ে ওঠা সমস্যার চটজলদি সমাধান নেই, কিন্তু একটা রাজনৈতিক দলের কোনও অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকবে না, আর এমন একটা উদ্যোগ সরকার নিতে পারে এখনই।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

রাজনীতি ও রসবোধ


 রাশেক রহমান
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছিল প্রায় অন্তঃসারশূন্য। সেই গতানুগতিক ধারা পরিবর্তনের সূচনা ঘটে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার পরে। রাজনীতিতে তিনি ফিরিয়ে আনেন একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদের দর্শন। ইংরেজ রাষ্ট্রনায়ক, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্যার উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন রাজনীতিবিদের পরবর্তী দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের ভবিষ্যৎ নিয়ে দূরদর্শিতা থাকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সেই ক্ষমতা থাকাও প্রয়োজন যিনি কোনও কিছুর ব্যত্যয় ঘটলে তার কারণ বলতে পারবেন। শুধু দূরদর্শিতায় নয় বরং বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক রসবোধও ফিরিয়ে এনেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি ভারত সফরে তিনি একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন তাতে দেখা যায় তার রসবোধ অনেক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও।
A
সম্প্রতি বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম নিয়ে যে আলোচনার ঝড় ওঠে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লিতে আইসিটি মৌর্য হোটেলের কামাল মহল হলে আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের (আইবিবিএফ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেভাবে কথা বলেন, সেটাতে অনেকে ভাবতে পারেন উনি হয়তো রসবোধ থেকেই বলছেন। তিনি তার বক্তব্যের মাঝে হঠাৎ করেই হিন্দিতে বলা শুরু করেন, ‘পেঁয়াজ মে থোড়া দিক্কত হো গিয়া হামারে লিয়ে। মুঝে মালুম নেহি, কিউ আপনে পেঁয়াজ বন্ধ কার দিয়া! ম্যায়নে কুক কো বোল দিয়া, আব সে খানা মে পেঁয়াজ বান্ধ কারদো (পেঁয়াজ নিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা। আমি জানি না, কেন আপনারা পেঁয়াজ বন্ধ করে দিলেন। আমি রাঁধুনিকে বলে দিয়েছি, এখন থেকে রান্নায় পেঁয়াজ বন্ধ করে দাও)।’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভারত রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়, আর তাতে সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশ। ভারত এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশকে আগে জানালে, ঢাকা অন্য কোনও দেশ থেকে পেঁয়াজ আনার ব্যবস্থা করে নিতো।’
A
A
বক্তব্যে তিনি এমনভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করেন যেখানে ফুটে ওঠে সমস্যার মূল কারণ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এবার সফরসঙ্গী হিসেবে তার সঙ্গে যাওয়ার এবং সামনে থেকেই এই বক্তব্য শোনার। প্রধানমন্ত্রীর এমন রসিকতাকে দর্শকরা করতালি দিয়ে স্বাগত জানান। আর রসবোধ নাড়িয়ে তোলে দিল্লির মসনদকেও। এর পরেই আমরা দেখি বাংলাদেশের স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পেঁয়াজ প্রবেশ করার বিষয়টি এবং একই সঙ্গে বাজারে স্থিতিশীলতা আসার ব্যাপারও।
A
১৯৪৮ সালে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াকে সাময়িকভাবে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু তখন কমিউনিস্ট পার্টি একজন তরুণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সেই সময়ে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডা. শ্রী বিধান চন্দ্র রায়। একজন ভালো বক্তা হিসেবে জ্যোতি বসুকে খুব পছন্দ করতেন ডা. রায়। তিনি জ্যোতি বসুকে ফোন করে বললেন, জ্যোতি তোমার জন্য একটা গাড়ি পাঠাচ্ছি। গাড়ি করে তুমি আমার বাড়ি চলে এসো। এখানে কয়েকদিন থেকো। আমি তো ছোট মাছ খাই, কিন্তু তুমি তো বড় মাছ খেতে ভালোবাসো, যেটা তুমি এখানে পাবে না। তবে ছোট মাছ ও ভাত তোমাকে আমি রোজই খাওয়াবো। এখানেই থেকো কারণ তুমি যদি না আসো তবে পুলিশের একটি ওয়ারেন্ট বের হয়েছে তোমার বিরুদ্ধে এবং সেটা দিয়ে পুলিশ তোমাকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যেতে পারে।
A
এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের মজা বা রসবোধ। কিন্তু এখানে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা ও তা বজায় রাখার বিষয়টিও সামনে চলে আসে।
A
শুধু রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও একদিকে দেখা যায় রসবোধ আর অন্যদিকে দূরদর্শিতা। এবারের ভারত সফরে এশিয়াটিক সোসাইটি অব কলকাতা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক টেগোর পিস অ্যাওয়ার্ড দেয়। সেখানে দেওয়া এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হলো তখন তৎকালীন গভর্নর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল হাই সাহেবকে ডেকে বলেছিলেন আপনারা এতো রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত করেন, নিজেরা একটা দুইটা রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না?’ জবাবে আবদুল হাই সাহেব বলেছিলেন, ‘যদি অন্য কেউ সঙ্গীত লেখেন তবে সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত কীভাবে হবে?’ নিজের বক্তব্যে এভাবেই পাকিস্তান আমলে সংস্কৃতি অঙ্গনে যে স্থবিরতা আনার চেষ্টা করা হয়েছিল তা ফুটিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তিনি তার বক্তব্যে প্রায়ই রসবোধের সঙ্গে এমনভাবে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলেন, যা ভাবিয়ে তোলে। আর রাজনীতিতে এই হিউমারটা ফিরে আসা খুবই জরুরি। ধ্বংসাত্মক বক্তব্য, কর্মকাণ্ড আর যাই হোক, রাজনীতিতে কখনও গঠনমূলক কিছু গড়তে পারে না। আর সেক্ষেত্রে এমন রসবোধ জন্ম দেয় এক নতুন ধারার রাজনীতি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। পৃথিবীর বিখ্যাত সব রাজনীতিবিদ যারা বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির চর্চা করেছেন, তাদের সবার মাঝেই রসবোধ, হিউমার খুঁজে পাওয়া যায়। আমার নেত্রীও ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত এবং বাস্তববাদী একজন রাজনীতিবিদ। আর তাই তো তিনি এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।
A
লেখক: রাজনীতিবিদ

ভিন্নমত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

 
 মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
ডিসেম্বর-মার্চ এলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গদ গদ করি। যদিও প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী সেই বিষয়টি মনে-প্রাণে ধারণ করাতো দূরের কথা, একটু বুঝতেও চেষ্টা করি না। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভেতরে ধারণ করতে চাইলে ধান্দাবাজি করা যাবে না সেই বিষয়টি অবশ্য জানি! তাই যে যা বলুক ভাই বাইরেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারণকারী হতে চাই!’– এমন চেতনাধারীতে এখন দেশ ভরে গেছে। আর এই কথিত চেতনাধারীরাই তাদের স্বার্থবিরোধী সত্য কথা বললেই যাকে-তাকে রাজাকার, জামায়াত, শিবির অভিধায় অভিহিত করে হয়রানি করছে। বুয়েটের ছাত্র আবরারের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলছে। যদিও সব শুদ্ধ মতের মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শর্ত।
A
পাকিস্তানিদের মতো সত্য কথা প্রকাশকারীদের দেশবিরোধী-ইসলামবিরোধী অভিহিত করাটা আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মনে হয়, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দূরে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরে যাচ্ছি। তাই ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে পাকিস্তানিদের কৌশল অবলম্বন করে যাকে-তাকে স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, জামায়াত, শিবির অথবা ইসলাম ধর্মবিরোধী, নাস্তিক ইত্যাদি বলছি।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের সমালোচনাকারীদের ‘ভারতের চর’ অথবা ‘নাস্তিক’ উপাধি দিয়ে দেশ ছাড়ার সব বন্দোবস্ত করে। যারা জন্মভূমির মায়ায় এদেশ ছেড়ে যেতে চায়নি, তাদের ওপর নেমে এসেছিল জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন। জেলের অন্ধকার কারাগার হয়েছিল তাদের ঠিকানা। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখের বালি। বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়াকে সমর্থন করলেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ইয়াহিয়া গংদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবীদের হতে হয়েছিল ধর্মদ্রোহী অথবা ভারতের দালাল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগী আল-বদর, আল-শামস, রাজাকাররা বাঙালি নিধনকে বৈধতা দিতেও এ তত্ত্ব ব্যবহার করে। তারা প্রচার করে, ‘ইসলাম ধর্মকে রক্ষা ও ভারতের দালালকে প্রতিহত করতেই তাদের এই অভিযান।’ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংগ্রাম পত্রিকার পাতায় পাতায় তৎকালীন বদর বাহিনী নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট।
ভিন্নমতাবলম্বীদের মতকে যুক্তি নয়, অস্ত্রের মাধ্যমে মোকাবিলা করার পাকিস্তানি মানসিকতা স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখা যায়। সামরিক শাসনামলে ভিন্নমত বা পথের মানুষ হওয়ার কারণে গোপনে বহু সামরিক- বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা না হলেও নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। হামলা-মামলার বহু ঘটনা ঘটেছে। সত্য বলায় বারবার বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো মহীয়সী নারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে অবস্থার খুব পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। কেউ আওয়ামী লীগ ও সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইত্যাদি বলে দমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু মতের পার্থক্য থাকায় অনেককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে শহীদ মিনারে। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিন্নমত সহজে গ্রহণ না করার ফলই আজকের শহীদ মিনার, স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ আমরা সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই ভিন্নমতকে যুক্তির মাধ্যমে নয়, শক্তির মাধ্যমে প্রতিহতের চেষ্টা করছি। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমরা চিন্তাচেতনায় কি সেই পাকিস্তানের দিকেই ফেরত যাচ্ছি?
আমরা ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সব মতের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে একমত নাও হতে পারি। তবে এই মতভিন্নতার কারণে যারা তাদের শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করছে অথবা রাজাকার, জামায়াত, শিবির বলে পিটিয়ে হত্যা করছে, হামলা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে, তাদেরও সমর্থক নই। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাষায় বলতে চাই: ‘আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাতে অবাধে বলতে পার, তার জন্য আমি নিজের প্রাণ অবধি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।’ এটা শুধু ভলতেয়ারের কথা নয়; আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাও বটে।
সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কথা বললেই সেটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়ে যায় না। রাষ্ট্র ও সরকার আলাদা দুটি সত্তা। ১৯৪৭ থেকে ৭১ (যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে বাদে) দেশপ্রেমিক রাজনীতিকরা পাকিস্তানি শাসনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শিক্ষক, সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীরা সত্য কথা বলেছিলেন। আর এই রুখে দাঁড়ানোর কারণ ছিল গণতন্ত্রহীনতা। আজ দেশ যদি সেই গণতন্ত্রহীনতার পথে হাঁটে, আর কেউ গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেন, তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু নয়, বরং প্রকৃত বন্ধু।
আজ যারা দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে কথা বলছেন তাদের রাজাকার বলে গালি দেওয়া, শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করা; আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করে তাহলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র আর সরকারের সমালোচনা করা এক বিষয় নয়। সরকারের সমালোচনা করলেই এখন তাকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভিন্নমত দমনের এই প্রতিক্রিয়া থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিশেষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসীদের উচিত হবে কাউকে রাজাকার, জামায়াত, শিবির, দেশবিরোধী বলার আগে তার অবস্থানকে বা বক্তব্যকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃষ্টিাকোণ থেকে বিচার করা। কেউ সত্য বললে তা মেনে নেওয়া। বিশ্বকবির ভাষায়: ভালো মন্দ যাহাই আসকু/সত্যেরে লও সহজে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়